২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বাহাদুর শাহ পার্ক : ইতিহাসের নীরব সাক্ষী

বাহাদুর শাহ পার্ক : ইতিহাসের নীরব সাক্ষী - ছবি : সংগৃহীত

ঢাকার পুরান শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ‘বাহাদুর শাহ পার্ক।’ স্থানটি শুধু একটি পার্ক নয়, এটি ইতিহাস, স্বাধীনতার আন্দোলন, এবং ঐতিহ্যের এক অমূল্য স্মৃতিস্তম্ভ। এটি ঢাকার অন্যতম পুরাতন উদ্যানগুলোর একটি। একসময় এটি পরিচিত ছিল ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক’ নামে। নাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পার্কটি ধারণ করেছে বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণের সংগ্রামের স্মৃতি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। ঐতিহাসিক এই পার্কটি শুধুমাত্র প্রকৃতির স্নিগ্ধতার কেন্দ্র নয়, বরং এটি ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের স্মৃতি বহন করে চলেছে।

অবস্থান ও এলাকা
বাহাদুর শাহ পার্ক ঢাকার পুরান ঢাকার সদরঘাট এলাকার উত্তরে অবস্থিত। এটি নওয়াবপুর রোড এবং বংশাল রোডের সংযোগস্থলের কাছে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে অবস্থিত। পার্কটি সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে প্রায় ১-২ কিলোমিটার দূরে এবং এর চারপাশে শহীদ সোহরাওয়ার্দী সড়ক, বংশাল রোড, এবং ফুলবাড়িয়া সড়ক রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে তথা বাংলাদেশে ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শাসন আমলের স্মৃতি-বিজড়িত বাহাদুর শাহ পার্ক আজও তার গৌরব নিয়ে রাজধানীর পুরান ঢাকার সদরঘাটের সন্নিকটে লক্ষীবাজার নামক স্থানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আন্টাঘর নাম থেকে ভিক্টোরিয়া পার্ক, সেখান থেকে আজকের বাহাদুর শাহ পার্ক।

পটভূমি ও নামকরণ

বাহাদুর শাহ পার্কের আগের নাম ছিল ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক।’ ১৮৫৮ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর এখানে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করেছিলেন, তাদের দমন করে শাস্তি দেয়া হয়। এই বিদ্রোহের সময় ভারতের শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর ছিলেন প্রতিরোধের প্রতীক। পরে স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯৪৭ সালে পার্কটির নাম পরিবর্তন করে ‘বাহাদুর শাহ পার্ক’ রাখা হয়।

শুরুতে ঢাকার আর্মেনীয়দের বিলিয়ার্ড ক্লাব ছিল এটি । যা স্থানীয়ভাবে ‘আন্টাঘর’ নামে পরিচিত ছিল। আন্টাঘর ক্লাবঘরটির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ঢাকার নওয়াব আব্দুল গণি ও নওয়াব আহসানউল্লাহ। ক্লাবটিতে ইংরেজরা বিলিয়ার্ড ছাড়াও টেনিস, ব্যাডমিন্টন খেলতো এবং আড্ডা দিতো। এখানে পার্টি-ফাংশনও আয়োজন করা হতো।
১৮৫৮ সালে রানী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করার পর এই ময়দানের নামকরণ হয় ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক’। ১৯৫৭ সালের আগে পর্যন্ত পার্কটি ভিক্টোরিয়া পার্ক নামে পরিচিত ছিল। মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের আমলে ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ ঘটে। ইংরেজরা বিদ্রোহ দমন করে এই পার্কের বিভিন্ন গাছে সিপাহীদের লাশ টানিয়ে রাখা হতো। মানুষ ভয়ে ইংরেজদের বিরুদ্বে কথা বলার সাহস না করে- এই ছিল উদ্দেশ্য। ১৯৫৭ সালে (মতান্তরে ১৯৬১) সিপাহি বিদ্রোহের শতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে পার্কের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক। ১৯৫৭ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত এর নাম বাহাদুর শাহ রয়ে গেছে।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

এ ময়দান বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে ১৮৫৭ সালে। ১৮৫৭ সালের ২২ নভেম্বর ইংরেজ মেরিন সেনারা ঢাকার লালবাগের কেল্লায় অবস্থিত দেশীয় সেনাদের নিরস্ত্র করার লক্ষ্যে আক্রমণ চালায়। কিন্তু সেপাহীরা বাধা দিলে যুদ্ধ বেধে যায়। যুদ্ধে আহত এবং পালিয়ে যাওয়া সেনাদের ধরে এনে এক সংক্ষিপ্ত কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে তাদের দোষী সাব্যস্ত করে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। বিচারের পর ১১ জন সিপাহীকে আন্টাঘর ময়দানে এনে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়া হয়। স্থানীয় লোকদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করতে লাশগুলো বহু দিন যাবৎ এখানকার গাছে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এ ঘটনার পর বহুদিন পর্যন্ত এই ময়দানের চারপাশ দিয়ে হাঁটতে ঢাকাবাসী ভয় পেত। কারণ এ জায়গা নিয়ে বিভিন্ন ভৌতিক কাহিনি ছড়িয়ে পড়েছিলো। সিপাহী বিদ্রোহ দমনের পর ইংরেজরা তাদের সেনাদের স্মরণে আন্টাঘর ময়দানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছিলো।

এছাড়াও এখানে ঢাকার নওয়াব স্যার খাঁজা আহসানুল্লাহর জ্যেষ্ঠ পুত্র খাজা হাফিজুল্লাহর স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। ১৮৮৪ সালে হঠাৎ হাফিজুল্লাহর অকাল মৃত্যুতে নওয়াব পরিবার তথা সারা ঢাকা শহরেই শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। তার স্মৃতি রক্ষার্থে ইংরেজরা এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করে। এখানে রয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। পার্কের স্মৃতিসৌধটি চারটি পিলারের উপর দাঁড়ানো চারকোনা একটি কাঠামো। উপরে রয়েছে একটি ডোম। অপরপাশে রয়েছে একটি ওবেলিস্ক, যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও ভারতবর্ষের সম্রাজ্ঞী হিসেবে রানী ভিক্টোরিয়ার সিংহাসনে আরোহন মনে করিয়ে দেয়।

রক্ষণাবেক্ষণ ও চ্যালেঞ্জ

পার্কটি যথেষ্ট ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করলেও এর রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে নানা সমস্যা রয়েছে। নোংরা পরিবেশ, অব্যবস্থাপনা, এবং অবৈধ দখলের মতো সমস্যাগুলো পার্কটির সৌন্দর্য ও গুরুত্ব হ্রাস করছে। এটা এখন অনেকটা পাবলিক টয়লেটে পরিনত হয়েছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এখানকার পরিবেশ নষ্ট করছে বিভিন্নভাবে।এখানে অনেকে মাদক সেবনের মত ঘৃন্যতম কাজও করে থাকে। সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগের মাধ্যমে এটি ঢাকার একটি সুশৃঙ্খল ঐতিহাসিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।


আরো সংবাদ



premium cement